বুধবার, ৩ মার্চ, ২০২১

এমএলএম ব্যবসা কী? | Social Nib | অর্থনীতি

মাল্টি লেভেল মার্কেটিং( এমএলএম ) বা বহুস্তর বিপণন হচ্ছে একটি ব্যবসায়িক মডেল যেটাতে ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে সরাসরি বিক্রয়কার্য সম্পাদন করতে হয়। এখানে মার্কেটিং এর জন্য আলাদা খরচ করতে হয় না। একে নেটওয়ার্ক মার্কেটিং , রেফারেল মার্কেটিং , পিরামিড সেলিং , সেলুলার মার্কেটিং নামেও অভিহিত করা হয়।  এর সম্পর্কে আমরা অনেকে শুনে থাকলেও মূলত আমরা বেশিরভাগ মানুষই জানি না এটা আসলে  কী আর কীভাবে কাজ করে। সোশ্যাল নিব-এর এই আর্টিকেলে জানতে পারবেন বিস্তারিত।



এমএলএম এর ইতিহাস

১৯৪৫ সালের দিকে ডা. কার্ল রেনবর্গ প্রথম এই কৌশলের সাথে সবার পরিচয় করান তার কোম্পানি নিউট্রিলাইট- এর মাধ্যমে। এর আগে ১৯১৫ থেকে ১৯২৭ পর্যন্ত চীনে থাকার সময় তিনি হেলথ সাপ্লিমেন্টের গুরুত্ব সম্পর্কে জানতে পারেন। পরবর্তীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে গিয়ে তিনি ক্যালিফোর্নিয়া ভিটামিন কোম্পানি গঠন করেন। ১৯৩৯ সালে তিনি কোম্পানির নাম পরিবর্তন করে রাখেন নিউট্রিলাইট। এর ৬ বছর পরে ১৯৪৫ সালে তিনি বিক্রয় বাড়ানোর লক্ষ্যে বহুস্তর বিপণন ব্যবস্থা চালু করেন।

ডা. কার্ল রেনবর্গ এমএলএম পদ্ধতি যিনি শুরু করেন
ডা. কার্ল রেনবর্গ 
ছবিঃ nutrilite.com.my


এমএলএম কীভাবে কাজ করে?

ধরুন আপনি রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন। সামনে দেখলেন একটা খালি বাস দাঁড়ানো। বাসের একজন কর্মী আপনাকে বলছে আপনি যদি ২ জন যাত্রী এনে দেন আপনি প্রতিজনের টিকেটের দামের ১০% করে টাকা পাবেন। আবার সেই দুইজন যদি আরও দুইজন করে নিয়ে আসে তারাও এই পার্সেন্টেজটা পাবে আর আপনি যেহেতু ওই দুইজনকে এনেছেন আপনিও সেই টাকার একটা অংশ পাবেন। সেই দুইজন চারজনকে আনলো, সেই চারজন আরও ৮ জন আনবে, সেই আটজন ১৬ জনকে। এভাবে বাস ভরে যাবে। সবার থেকে আপনি একটা অংশ টাকা পাবেন। আর আপনি যেহেতু সবার উপরে তাই আপনার আয় হবে সবার চেয়ে বেশি। কিন্তু শর্ত হচ্ছে আপনাকে আগে একটা টিকেট কিনতে হবে, এর পরে আপনি দুইজনকে এনে ইনকাম করতে পারবেন। এমএলএম কোম্পানি অনেকটা এমন ভাবেই কাজ করে। এখানে প্রোডাক্টের গুনাগুন শুনে তেমন কেউ জয়েন করে না। বেশিরভাগ মানুষ জয়েন করে অর্থ আয়ের জন্য। 

এমএলএম পিরামিড সেলিং মডেল
 পিরামিডের সাথে সদৃশ্য তাই একে পিরামিড সেলিং মডেলও বলা হয়


এমএলএম কোম্পানি গুলোর নিজেদের প্রোডাক্ট বাজারজাতকরণ করতে কোনো খরচ করতে হয় না। প্রয়োজন হয় না কোনো বিক্রয়কর্মীর। দিতে হয় না কোনো বেতন। মডেলের সাথে যুক্ত প্রত্যেকে মনে করে সে অনেক উপরে অবস্থান করছে। বাস্তবে তার উপরেও অনেক জন থাকে। বেশিরভাগ সময় এমএলএম মডেলের সাথে যুক্ত মানুষেরা নিজেদের পণ্যের গুনাগুন বর্ণনা করে পণ্য বিক্রয় করে না। তারা টার্গেট কাস্টোমারদের বলে, “নেটওয়ার্ক মার্কেটিং বা এমএলএম মডেল ফলো করলে একটা সময় আপনি প্রতি মাসে লাখ লাখ টাকা আয় করতে পারবেন। কিন্তু তার আগে আপনাদের কিছু বেসিক প্যাকেজ কিনতে হবে।” আর এই প্যাকেজের নামেই তারা বিক্রি করে দেয় তাদের প্রোডাক্ট। পরবর্তীতে সেই টার্গেট কাস্টোমাররাও একই পন্থা অবলম্বন করা শুরু করে।


পিরামিড স্কিম 

পিরামিড স্কিমের বেশিরভাগ মানুষই হয় নিঃস্ব
ছবিঃ jagoinvestor.com
পিরামিড স্কিমও অনেকটা এমএলএমের মত। তফাৎ শুধু একটা জায়গায়। এমএলএমে পণ্য থাকে। কিন্তু এখানে পণ্য বা সেবা কিছুই থাকে না। এখানে আপনাকে বলা হবে একটা নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা বিনিয়োগ করতে। এরপরে আরও কিছু ব্যক্তিকে প্রলুব্ধ করে বিনিয়োগ করাতে। উদাহরণ হিসেবে বলতে গেলে, আপনাকে বলবে আগে ১০,০০০ টাকা বিনিয়োগ করেন। এরপর ৩ জনকে রেফার করে বিনিয়োগ করান। সেই ৩ জন আরও লোকজন আনবে। সেই ৩ জন আপনার প্রত্যক্ষ বিনিয়োগকারী হওয়াতে তাদের বিনিয়োগ থেকে আপনি ১০% করে পাবেন। আর সেই ৩ জন যাদেরকে আনবে তাদের থেকে আপনি পাবেন ৩% করে। পিরামিড স্কিমকে নানা ভাবে উপস্থাপন করা হয়। বলিউডের জনপ্রিয় ফির হেরা ফেরি দেখানো  একটা কোম্পানি হয়েছিলো পঁচিশ দিনে বিনিয়োগের টাকা দ্বিগুন করে দেয়া হবে। কিন্তু দিন শেষে সেই কোম্পানি ছিলো একটি প্রতারক স্ক্যাম কোম্পানি। এভাবে অনেক কোম্পানি মানুষদের নানা প্রলোভণ দেখিয়ে পিরামিদ স্কিমে বিনিয়োগ করিয়ে নেয়। আর দিন শেষে তাদের পথে বসায়। বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক দেশে এই পিরামিড স্কিম আইনগতভাবে নিষিদ্ধ আর দণ্ডনীয় অপরাধ। 



পিরামিড স্কিম ও এমএলএম 

আমরা ইতোমধ্যে দেখেছি পিরামিড স্কিম এবং এমএলএমের মধ্যে একটাই পার্থক্য। এমএলএম সিস্টেমে পণ্য বা সেবা থাকাতে এটি অনেক জায়গায় বৈধ। কিন্তু অনেক বিশেষজ্ঞদের মতে এমএলএম হচ্ছে বৈধ গ্লাসে নিষিদ্ধ মদের মত। অনেক নেটওয়ার্ক মার্কেটিং কোম্পানি পণ্য বা সেবার মাধ্যমে শুধু চোখে ধুলো দিয়ে কৌশলে পিরামিড স্কিম বাস্তবায়ন করে থাকে। 



 

বাংলাদেশে এমএলএম

বাংলাদেশে এমএলএমের ইতিহাস কখনোই ভালো ছিলো না। কিছু ঘটনা দেখে নেয়া যাক।

এমএলএম সিস্টেম অনুসারী ‘ইউনি-পে’ কোম্পানি স্বর্ণের লোভ দেখায় আর হাজারো মানুষের কাছ থেকে হাতিয়ে নেয় কোটি কোটি টাকা। কোম্পানিটি যখন সচল আর সক্রিয় সদস্য সংখ্যা অনেক তখনই হঠাৎ করে বন্ধ হয়ে যায় কোম্পানিটি। পালিয়ে যায় কোম্পানির সব প্রভাবশালী কর্মকর্তা। হাজারো কোটি টাকা লুট করে পথে বসিয়ে দেয় লাখেরও বেশি তরুণদের। 

এর প্রায় এক বছর পরে‘ডেসটিনি’ নামক আরেক এমএলএম কোম্পানির হাত ধরে আবারো ফিরে আসে আগের সেই প্রতারকেরা । কোটি টাকা আয়ের লোভ দখিয়ে একশ্রেণির তরুণ-তরুণী, গৃহীনি, ব্যবসায়ী , শিক্ষার্থী, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবী, মিশন ফেরত আর্মি অফিসারদের কাছ থেকে আবারও হাতিয়ে নেয় হাজার কোটি টাকা। ডেসটিনির পরিচালকদের বিরুদ্ধে প্রায় চার হাজার কোটি টাকা পাচারের মামলা করে বাংলাদেশ সরকার। তাদের বিরুদ্ধে ১০০ কোটি টাকা বিদেশে পাচারের প্রমাণ পায় বাংলাদেশ ব্যাংক। ডেস্টিনি বন্ধ হয়ে যায়। দেশে নিষিদ্ধ করা হয় এমএলএম ব্যবসা। 

শুধু বাংলাদেশ নয় ,পুরো উপমহদেশেই এমন অনেক স্ক্যাম অনেক হয়েছে। উপমহাদেশে মূলত টার্গেট করা হয় কলেজ শিক্ষার্থী আর গৃহিনীদের যারা একটু বাড়তি আয় করতে চায়। নানা ধরনের প্রলোভন দেখানো হয়। উপমহাদেশের এমএলএম মডেলের সদস্যদের সবচেইয়ে কমন দিকটা হলো এরা বেশিরভাগ সময় স্যুট ,টাই পরে ঘুরবে। অফিসের ছবি তুলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আপ্লোড করবে। যাতে সবাই তাদের জিজ্ঞাস করে তারা আসলে করে টা কী। এরপর সদস্যরা তাদের কথির বিজনেস প্ল্যান বলে। ফ্রিল্যান্সিং কোর্স, বিউটি প্রোডাক্টসহ নানা ধরণের পণ্যের আড়ালে প্রতিদিনই চলছে এমএলএম ব্যবসা। 

ফ্রড এমএলএম কোম্পানি ডেস্টিনি ২০০০ লি.



সব এমএলএম প্রতিষ্ঠান কি ফ্রড?

সত্য বলতে গেলে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বেশিরভাগ নেটওয়ার্ক মার্কেটিং প্রতিষ্ঠানই ফ্রড। বেশিরভাগই কৌশলে পিরামিড স্কিম বাস্তবায়ন করে। পথে বসে শতশত স্বপ্নবাজ তরুন-তরুণী। কিন্তু আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে কিছু কোম্পানি আছে যারা অনেকদিন যাবত টিকে আছে কারণ তারা নিত্যদিনের দরকারী পণ্য ও সেবার মাধ্যমে বহুস্তর বিপণন বাস্তবায়ন করে। 

 



শেয়ার করুন

Author:

Etiam at libero iaculis, mollis justo non, blandit augue. Vestibulum sit amet sodales est, a lacinia ex. Suspendisse vel enim sagittis, volutpat sem eget, condimentum sem.

0 coment rios:

Share your opinion with Social Nib